মাহবুব আলম প্রিয়ঃ
তুরুণ প্রজন্ম নিয়ে খুব একটা চিন্তিত অভিভাবক ও সমাজপতিরা তেমন চিত্র দেখা যায় না অথচ সমাজে কিশোর গ্যাং, কিশোর অপরাধীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সবচেয়ে ভয়াবহভাবে যে চিত্র দেখছি তা হলো চরম বেয়াদবি। ছোটরা বড়দের সম্মান দিচ্ছে না। বড়দের সামনে প্রকাশ্যে ধুমপান করছে৷ বেপরোয়া বাইক চালিয়ে নানা অঙ্গ ভঙ্গিতে নারকীয় পরিবেশ তৈরী করছে৷ প্রতিবাদ করলে সংঘবদ্ধ হামলা করছে। শিক্ষকদের সামনে ইভটিজিং করছে৷ পুলিশ কিছু করতে পারছে ওরা শিশু বলে। কিশোর অপরাধ বলে ইচ্ছে থাকলেও আইনি কঠোরতা নাই অযুহাতে সব যেন সহজতর হচ্ছে। তবে বড়রা যে ছোটদের আদর করছে তাও নয়। সব মিলিয়ে বয়সে ছোট বড়দের একটা আচরনে আদবহীনতা লক্ষনীয়।
কারন হিসেবে বলা যায়, ক্রমাগত স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে তা একসময় স্বার্থপরতা হয়ে দাঁড়ায় পরস্পর । মানুষে মানুষে দূরত্ব, অবিশ্বাস বেড়েই চলার ফল নতুন প্রজন্মকে ঘিরে আছে। ফলে আশা-ভরসা কাগজের নৌকা বানিয়ে অনির্দিষ্ট পথে ভাসিয়ে দিচ্ছে।
সমাজে একসময় সংস্কৃতির জোরই দেশ ও মানুষের জোর ছিল। নগদ প্রাপ্তির কালে বাকির খাতায় চলে যায় সংস্কৃতি পালন। এখন জোর বলতে বোঝায় অন্য কিছু। সেই জোরের চর্চা পরিচর্যায় উচ্ছন্নে যাওয়াকে উন্নতি বলে। তেমন উন্নতি লাভের জন্য হুলুস্থুল কাণ্ডে সমগ্র ক্ষেত্রে অভিভাবকত্ব দিশেহারা। নতুন ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যে চারপাশ ভুলে আপন আপন ভুবনে নেশাগ্রস্তের মতো ডুবে আছে, তাকে অস্বাভাবিকতা ভাবা যায়। ভাবা হচ্ছে। সেই স্বভাব দোষের হলে নিজেরা যে একেবারেই যে দোষহীন, তার পক্ষে জোরদার যুক্তি কি অভিভাবক শ্রেণির মুঠোতে রয়েছে? কুড়ি-ত্রিশ বছরে যারা নতুন প্রজন্ম পরিচয়ে বেড়ে উঠেছে, উঠছে, তারা কেউই আমি বা আমাদের মতো নয়। তারা আমাদের মতো হবে, এমন আশা কেন করা? তাদের ভাব, ভাষা, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং ধ্যানধারণা বুঝতে চাওয়ার, নিকটের হওয়ার কতখানি উদ্যোগ চোখে পড়ে?
সমস্যা কোথায়? অস্বস্তি বা হতাশায় ভোগার তরুনদের নিয়ে সমাজের দায়িত্বশীলদের কর্মসূচীটা কোথায়? নিজের সন্তানদের সাথে যেমন বাবা মায়ের দূরত্ব বাড়ছে তেমনি সমাজ ও সামাজিক কর্ম থেকে তরুণরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে তথাকথিত রাজনীতি আর গ্যাং অনুসরণের কারনে।
বাস্তব চিত্র দেখা যায়, সমাজে একে অন্যের প্রতি সহনশীলতা ও সম্মানবোধ কমে যাচ্ছে। মানুষের সব ধর্ম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকায় অন্য ধর্মকে সম্মান করার চর্চা ওঠে গেছে। তাই সমাজে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাধানের জন্য সামাজিক মাধ্যমের সঠিক ব্যবহার জানার পাশাপাশি যার যার ধর্ম বিশ্বাস ও রাজনৈতিক বিশ্বাস প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টে কোন কিছু লেখা, লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করা নিয়ে মৃদু বিরোধ দেখা যায়৷ পাশাপাশি পরিবার, প্রতিবেশী, সমাজের গন্যমান্যদের সামনে তরুনদের নানা আচরনগত বেয়াদবি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে দিন দিন হিংসাত্মক ও সমাজ বিরোধী কাজে জড়িত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। তরুণরা খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কাজে জড়িত থাকলে এই প্রবণতা কমার কথা ছিলো। কিন্তু মাঠের অভাবে আর মোবাইল আসক্তিতে ডুবে জুয়ায় লিপ্ত হয়ে শারীরিক কসরত যুক্ত খেলাধুলাকে অবহেলা করছে।
অভাব রয়েছে ধর্মীয় মুল্যবোধের। ধর্ম ও নীতি নৈতিকতার অভাব থেকে তরুনরা বিপদগামী হচ্ছে বেশি। সব ধর্মের মূল কথা হচ্ছে মানবিকতা ও ন্যায়বোধকে ধারণ করা। ধর্মের সঠিক অর্থ তরুনদের মাঝে পৌঁছে দিতে শিক্ষক, অভিভাবক ও সমাজের দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতা অস্বীকার করা যাবে না। বলা হয়ে থাকে আদর দিলে শ্রদ্ধা মেলে। শ্রদ্ধা করলে আদর পাওয়া যায়৷ কিন্তু আমরা দেখি আদর পেয়ে বাদরের মতো দুষ্টু (বানর) হতে আর শ্রদ্ধা পেয়ে পেয়ে আদরের মানুষগুলোকে অবহেলা করতে। ফলাফল বেয়াদবী প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। বড়দের দেখলে সালাম কালাম, বসতে বলা, সম্মান দেয়ার প্রবণতা দেখা মেলা ভার।
বিশেষজ্ঞরা দাবী করে আসছেন, ইন্টারনেটের অপব্যবহার বন্ধে পরিবারকে সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে।
ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর—এই সতর্কবাণী লেখা থাকে সিগারেটের প্যাকেটে। প্রকাশ্যে ধূমপান করলে জরিমানার আইনও দেশে আছে। এই সতর্কবাণী লেখাতে সীমাবদ্ধ নয়। প্রয়োগ করতে দায়িত্বশীলদের হস্তক্ষেপ জরুরী।
শুধু কি তাই, তরুণরা নেশা আসক্তিতে জড়াচ্ছে। অনেকে বিরক্ত নিয়ে বলে থাকেন,
নেশা খাবি খা মারা যাবি যা’—। আসলে কি কেউ কারো মৃত্যু চাই? বা চায়? জেনে বুঝেও নেশার ছোঁবল গ্রহণকারীরাতো আত্নহত্যার মতো জঘন্য কাজ করেন।
এত কিছু জানার পরও যদি কেউ সর্বনাশা নেশার পথে পা বাড়ায় তাহলে দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া তো কিছুই করার থাকে না। এমন বাজে পরিবেশের জন্য কি পরিবার দায়ী নয়? ধরি, কোনও পরিবারে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও প্রকাশ্যে ধূমপান করতে শুরু করলো। বাবা সিগারেট খান, ছেলেও সিগারেট খায়। মা সিগারেট খান, মেয়েও সিগারেট খায়। তাদের দেখাদেখি বাড়ির কাজের ছেলে-মেয়েরাও সিগারেট খায়। তাতে দোষের কী? এভাবেই তো সিগারেট থেকে শুরু করে মদ,গাঁজা আফিম, হেরোইন, ইয়াবা,আইসের বিস্তার ঘটে।
তরুনদের অপরাধ প্রবণতায় প্রবেশের প্রথম ধাপ সিগারেট। অসৎ সঙ্গ। গ্যাং করে অপরাধের ভয়াবহতায় যুক্ত হওয়া সবশেষে ধর্ষনের মতো পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার। যা ইতোমধ্যে সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বাস্তবে
সামাজিক অবক্ষয়, মাদকের বিস্তার, কর্মহীনতা, আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকা, পর্নো ছবির অবাধ বিক্রি, সর্বোপরি নারীর প্রতি পুরুষের হীন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা। ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতরা হয়ে পড়ছে অপ্রতিরোধ্য। শিশু থেকে কিশোরী, যুবতী থেকে বৃদ্ধা, স্কুলছাত্রী থেকে পোশাককর্মী, ডাক্তার, আইনজীবী এমনকি ভিখারিনীও রেহাই পাচ্ছে না মানুষরূপী এসব হায়নাদের হিংস্র থাবা থেকে। ধর্ষকরা শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত থাকছে না, ঘটনা ধামাচাপা দিতে ঘটাচ্ছে নৃশংস হত্যাকা-।
সম্প্রতি ধর্ষণের ভয়াবহতা ও ধর্ষণ-পরবর্তী নির্যাতনের লোমহর্ষক সব ঘটনায় আঁতকে উঠছে দেশবাসী। ধর্ষণ রুখে দিতে প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিকার গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান কল্পনাতীত ধর্ষণ ও ধর্ষণ প্রবণতার বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে এখন বড় ধরনের সামাজিক গবেষণার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ কেন এতটা বেপরোয়াভাবে যৌনতাড়িত হয়ে পড়ছে, কেনই বা ধর্ষণ প্রবণদের মধ্যে কাজ করছে না কোনো ধরনের ভয়ভীতি, এটা এখন এক বড় প্রশ্ন। ধর্ষকদের কেউ কেউ গ্রেফতারও হচ্ছে। অথচ সেসব দৃষ্টান্ত কোনোই কাজে আসছে না। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ধর্ষণ প্রবণতা এক অপ্রতিরোধ্য মানসিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে, যা শুধু আইন প্রয়োগ করেই দমানো যাবে না। প্রকৃতপক্ষে মানুষের নৈতিক অবক্ষয় সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে এবং তাই সে মানতে চাইছে না কোনোকিছুই। আইন-আদালত, সামাজিক সম্মানবোধ, আত্মসম্ভ্রম। আমরা মনে করি, ধর্ষণ রোধে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি এই প্রবণতার কারণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। ধর্ষণপ্রবণতার পেছনে দেশের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা কতটা দায়ী সেটাও অনুধাবন করার প্রয়োজন পড়েছে।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা একটি সামাজিক সমস্যা। মানুষের মধ্যে যে আদিম প্রবৃত্তি, তা দমিয়ে রাখতে হলে শৈশব থেকে বা পরে স্কুল-কলেজে যথাযথ জ্ঞানচর্চা, নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। মূলত সচেতনতার অভাবেই বাড়ছে ধর্ষণের মতো ঘটনা। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে ধর্ষণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। এসব পরিবার সব সময়ই নানা ধরনের টানাপড়েনের মধ্যে থাকে। এর সুযোগ নেয় এক ধরনের নরপশুরা। তারা সুযোগ বুঝে এসব পরিবারের শিশুদের নিজের কাছে নেয় এবং অবুঝ শিশুরা তাদের লালসার শিকার হয়। কতিপয় শিক্ষকদের কাছেও নিরাপদ থাকে না তারা। এসব নানা কারনে অনাস্থা ও অনিরাপদ সমাজে বেয়াদবি নামীয় বিকৃত আচরন রপ্ত করছে তরুন সমাজ। শুধু যে তরুণ তা নয়, সব বয়সে এমন অমানবিক অবক্ষয় লক্ষনীয়।
বর্তমানে যেভাবে শিশুরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, তাতে আতঙ্কিত করে তুলেছে পুরো সমাজকে।
আমনা মনে করি, ধর্ষণ রোধে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি এই প্রবণতার কারণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। ধর্ষণ প্রবণতার পেছনে দেশের প্রচলিত রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থা কতটা দায়ী সেটাও অনুধাবন করার প্রয়োজন পড়েছে। আর্থিক দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে দেশ, এই দুর্নীতি হয়তো মানুষকে উৎসাহী করছে চারিত্রিক অন্যান্য স্খলনেও। অনেকেই বলছেন, সমাজটা যেহেতু ভোগবাদী হয়ে পড়েছে, তাই মানুষ নানা ধরনের ভোগে প্রলুব্ধ হতেই পারে। এই প্রলুব্ধতার পেছনে কোনো ধরনের নৈতিকতা কাজ করছে না।
বাংলাদেশ এক জনবহুল রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের কোথায় কী ঘটছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে তার সব খোঁজ রাখা সম্ভব নয়। জাতিকে নৈতিকতাসমৃদ্ধ করে তুলতে না পারলে ধর্ষণের মতো অপরাধ থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না। আমরা জোর দিয়েই বলতে চাই, দেশের অপরাধ বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সমাজ বিশারদ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব সবাইকে একত্র হয়ে ধর্ষণ প্রবণতার কারণগুলো চিহ্নিত করে সে মোতাবেক এই রোগের নিরাময়ের উপায় বের করতে সচেষ্ট হতে হবে।
সর্বোপরি আমরা আমাদের তরুণ প্রজন্মের মাঝে সামাজিক, পারিবারিক মুল্যবোধ, ব্যক্তিত্ব,নীতি নৈতিকতা জাগ্রত করে দেশপ্রেমে যুক্ত করে দিতে পারলে বেয়াদব মুক্ত প্রজন্ম পেতে পারি। যার আজ তরুণ কাল যুবক,বৃদ্ধের পথে। তাদের মাঝে সম্মান দিলে সম্মান বাড়ে এমন উপলব্ধি বুঝানোর সক্রিয় কর্মশালা বহাল রাখা জরুরী৷
লেখক: মাহবুব আলম প্রিয়
সাংবাদিক