নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
মেঘনা থেকে অবৈধ বালু কাটা বন্ধে এবার নদীপারের এলাকাবাসীও নেমে পড়েছে বালু খেকোদের ধাওয়া করতে। বৃহস্পতিবার দুপুরে দেশীয় লাঠি সোটা হাতে কয়েকটি নৌকা করে গিয়ে ভাঙন কবলিত মতলব উত্তর এলাকার মানুষ ড্রেজিং এবং বাল্কহেডকে ধাওয়া করে। মতলব উত্তরের মোহনপুর ইউপির বাহাদুরপুর গ্রামের যুবক আমির হোসেন কালু জানান, বৃহস্পতিবার সকালে ২৫/৩০ টা ড্রেজার ঐ গ্রামের পাশ লাগুয়া অবৈধভাবে বালু তোলা শুরু করে। এসময় শত শত গ্রামবাসী তাদের বাধা দেয়। তখন বাধা উপেক্ষা করে তারা মারমুখি হয় গ্রামের মানুষদের উপর। পরে তরুন যুবকরা তাদের নৌকা স্পীড বোটে তাদের ধাওয়া করে। এসময় বালু খেকোদের নিয়োজিত শ্রমিকরা তাদের ড্রেজিং এবং বাল্কহেড জোরে চালিয়ে পালিয়ে যেতে দেখা যায়। এই সময় তারা ড্রেজিং জাহাজ থেকে গুলিও ছোঁড়ে। সাথে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। বালু খেকোরা আচমকা সংঘাত এড়াতে পারবে না বিধায় তাড়াতাড়ি স্থান ত্যাগ করে মুন্সিগন্জ শরীয়তপুরের নদী সীমান্তে চলে যায়। যদিও মতলব উত্তর উপজেলা প্রশাসন, নৌ পুলিশ বলছে, এটি চাঁদপুর নদী এলাকার না, এটি মুন্সিগঞ্জ ও নারায়নগন্জ এলাকার।
স্থানীয়দের দাবি – একটি চক্রবদ্ধ চক্র দীর্ঘদিন অবাধে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছিলো মতলব উত্তর ষাটনলসহ ইলিশ অভয়াশ্রম এলাকায়। এটি তাদেরই কাজ। এদিকে সম্প্রতি চাঁদপুরের ৭০ কিলোমিটার বেশির ভাগ এলাকা থেকেই বড় ধরনের বালু খেকো সেলিম খানের ৩ শতাধিক অবৈধ ড্রেজার, কয়েক শ বাল্কহেডকে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ ও বালু বিক্রি না করার আদেশ দেয়া হলো, নদী রক্ষা কমিশন এবং আদালতের আদেশে স্থগিত হলো, তখন পদ্মা মেঘনা থেকে কয়েক “শ ড্রেজার বাল্কহেড পালালো। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, কোষ্ট গার্ড, নৌ পুলিশরা অনেক ড্রেজার জব্দ করে। আটক করে বেশ কয়েকজন শ্রমিককে। এরপর গত তিন সপ্তাহ চাঁদপুরের ইলিশের অভয়য়াশ্রম এলাকার ৭০ কিলোমিটারের ৬০/৬৫ কিলো মিটার এলাকায় বালু উত্তোলন বন্ধ হলেও মতলব উত্তরে মুন্সিগন্জ জেলা সীমান্ত লাগোয়া এলাকা চাঁদপুর সীমানায় বালু তুলছে বালু খেকোরা। ২ জেলার সীমান্ত এলাকায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সংবাদ পেয়ে মঙ্গলবার চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অন্জনা খান মজলিশ মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসককের সাহায্য কামনা করেন। পরদিন বুধবার ঐ জেলা প্রশাসক তার এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এসিল্যান্ডসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঘটনাস্থলে পাঠান। আর এদিক থেকে মতলব উত্তরের নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার ভুমি সহ একটা টিম পাঠান চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অন্জনা খান মজলিশ। পরবর্তীতে উভয় প্রশাসন নদীর সীমা নির্ধারণ করে একাধিক বয়া এবং লাল নিশানা টানিয়ে আসেন। জানা গেছে, মুন্সিগন্জ এলাকায় মেঘনা থেকে বালুমহাল এবার ইজারা দিয়েছে প্রশাসন। কিন্তু নিজ সীমানার দিকে তোয়াক্কা না করে চাঁদপুরের ইলিশ অভয়াশ্রমের মধ্যে এসে বালু উত্তোলন করছে এমন অভিযোগ আসতে শুরু করলে এই ব্যবস্থা করে প্রশাসন। কিন্তু এই চাঁদপুরের অন্চলের আরেক বালু খেকোর সক্রিয় হয়ে উঠে এর ধারে কাছেই! অভিযোগ রয়েছে, বালু খেকো সেলিম খান
চাঁদপুর সদর ও হাইমচর এলাকায় বালু উত্তোলন করতে না পেরে এই বালু খেকোর চোখ পড়ে মেঘনা-ধনাগোদা বেড়িবাঁধ বেষ্টিত মতলব উত্তর উপজেলার দিকে। মতলব উত্তরের সীমা রেখার মধ্যে বালু খেকোদের ড্রেজার আক্রমনের পরও মতলব উত্তর বৃহস্পতিবার সকালে মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল ইউনিয়নের সীমানা দিয়ে বয়ে যাওয়া মেঘনা নদীতে গিয়ে দেখা যায়, বালু উত্তোলন করছে মেসার্স বিজয় ট্রেডার্সের লোকজন। এর সত্ত্বাধিকারী মুন্সীগন্জের ফারুক হোসেন । এলাকার মানুষের কাছে আরেক বালু উত্তোলনকারী কাজী মতিন । সেদিনের এই ঘটনায় সে জড়িত বলে এলাকার লোকজন জানায়। নদীর তীরের মানুষেরা দেখতে পায়, নিষেধাজ্ঞার পরও তারা আপনমনে বালু কেটে যাচ্ছে। এ অবস্থায় নদীর দু’দিক থেকে স্থানীয় জনতা একত্রিত হয়ে নৌকায় ধাওয়া করে মাটি কাটার ড্রেজারকে। তখন জনতা দশানীর আলো নাবিক-৩ ড্রেজারে আক্রমন করে। স্থানীয়দের দাবী শরীরের রক্ত থাকাবস্থায় মতলব উত্তরের সীমানায় কোন মাটি কাটতে দেয়া হবে না। তারা যেখানে ড্রেজার চালাচ্ছে সেখানে আমাদের পূর্ব পুরুষরা বসবাস করত। কোনক্রমেই মতলব উত্তরের সীমানায় বালু কাটতে দেয়া হবেনা। জনতার আক্রমনে ড্রেজার চালকরা দ্রুতগতিতে চালিয়ে জান ও মাল রক্ষা করে। এ ব্যাপারে কাজী মতিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমার একটা ড্রেজার আছে, সেটি আমি মাসিক হিসাবে ভাড়া দিয়েছি মুন্সিগঞ্জের চর আবদুল্লাহপুরে বালু তুলতে। তিনি অস্বীকার করে বলেন, বাহাদুরপুর নদী এলাকায় বালু কাটা হয় না, হয় চর আবদুল্লাহপুরে। আর মুন্সিগন্জের এই জায়গাটা চাঁদপুরের কাছে। ফলে আমাদের এখানের মানুষ বালু উত্তোলনের সময় ক্ষেপে উঠৈন। তার দাবি – এখানে কিছু মানুষ রাজনীতিক ছায়ায় ধান্দাতেও থাকে।
জানা গেলো, ফরাজীকান্দি, এখলাছপুর, মোহনপুর, কলাকান্দা ও ষাটনলের লোকজন যেকোন মূল্য মাটি রক্ষা করতে প্রস্তুত। তারা সেখানে সংঘবদ্ধ হচ্ছে এদের বিতাড়িত করতে।
এদিকে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ও চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের কাছে অনতিবিলম্বে বালু উত্তোলন বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে অনুরোধ জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তাদের আশংকা, না হয় এখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে।
স্থানীয়রা জানান, আমাদের বুকের উপর ড্রেজার চালালে যে কষ্ট পাবো তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাই মেঘনা নদীতে কেউ অবৈধপন্থায় ড্রেজার চালালে। এই মেঘনার করাল গ্রাসে আমরা শেষ। ১ বার নয়, ২ বার নয়, অন্তত ৫ বার নদী গর্বে হারিয়ে গেছে আমাদের বসত ঘর ও ফসলী জমি। আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত।
বাহাদুরপুরের বাসিন্দা, ইউপি সদস্য আলমগীর কবিরাজ, নান্নু মিজি ও জামান মিজি জানান, মোহনপুর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড বাহাদুরপুর। বালু খেকোরা আমাদের ওয়ার্ডের নিকটবর্তীস্থানে মোহনপুরের বালু সন্ত্রাসীদের নেতৃত্বে বালু উত্তোলনের করছে দেখে। আমরা ওয়ার্ডবাসী একত্রিত হয়ে তাদেরকে প্রতিরোধ করেছি। ৫টি স্পীডবোট যোগে মতিন কাজির নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা আমাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। ভাগ্য সুপসন্ন কেউ হতাহত হয়নি। তবে মতউত্তরের এলাকাবাসী আরো বলছেন এলাকার সাংসদ নুরুল আমিন রুহুল এবং একই এলাকার প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম দৃষ্টি আকর্ষণ করছি তারা যেনো মতলব উত্তর কে বাঁচান।
এদিকে এ ব্যাপারে,মতলব উত্তর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গাজী শরীফুল হাসানের সাথে কথা হলে তিনি জানান, এমন ধাওয়ার ঘটনাটি একটা সামাজিক যোগাযোগের ভিডিওতে দেখেছি। লোকজনও জানিয়েছে। তবে এই ড্রেজার কারা চালাচ্ছে, কারা বালু তুলছে এবং কোন জাযগায়, বিষয়টি যাচাই বাছাই করে দেখতে হবে। আমরা এর আগে বালু উত্তোলন হয় চাঁদপুর সীমান্তে এমন খবরে তা মীমাংসা করে দিয়েছি ২ জেলার নদী সীমানা ঠিক করে দিয়ে, বয়া বিকন ও লাল পতাকা টানিয়ে। সতর্ক করে দিয়ে এসেছি। তিনি বলেন, যদি চাঁদপুরের নদী সীমানায় আবার বালু তোলার ঘটনা সত্যিই ঘটে থাকে, তাহলে আমরা দ্রুতই এ্যাকশনে যাবো।
নৌ পুলিশ সুপার কামরুজ্জামানের সাথে কথা হলে তিনি জানান, চাঁদপুরের ৭০ কিলোমিটার নদী অন্চলে আমাদের জানামতে বালু উত্তোলন হয় না। যেটি হচ্ছে, তা মুন্সীগন্জ সদর এলাকা এবং নারায়গন্জ জেলার কিছু এলাকা জুড়ে। যে জায়গাকে সেখানকার প্রশাসন বালু মহাল হিসাবে ইজারা দিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা জেনেছি হঠাৎ করে ঐ বালুমহলে অজস্র ড্রেজিং লাগানো হয়েছে।