সেলিম খান চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। আর অপর দুজন হলেন স্থানীয় বাসিন্দা জুয়েল ও আবদুল কাদের মিয়া।
রিটের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত ৩ মার্চ হাইকোর্টের এই বেঞ্চ রায়ের জন্য ২০ এপ্রিল দিন ধার্য করেছিলেন। এর মধ্যে বেঞ্চটি পুনর্গঠন করা হয়। ফলে, ধার্য তারিখে রায় হয়নি। গতকাল বৃহস্পতিবার বেঞ্চটি বিশেষভাবে বসেন এবং রায় ঘোষণা করেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে নিয়োজিত ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান। রায়ের পর তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণে যেসব পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় জেলা প্রশাসন করেছে, তা সঠিক বলে রায়ের পর্যবেক্ষনে এসেছে। রিট আবেদনকারীরা আদালতে কিছু জাল ডকুমেন্ট দিয়েছেন। আদালতের সময় নষ্ট করেছেন। এসব বিবেচনায় নিয়ে রুল খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে সেলিম খানকে ৫০ লাখ টাকা ও অপর দুজনকে ২৫ লাখ টাকা করে জরিমানা করেছেন আদালত।
চাঁদপুর জেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন সুত্রে খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬২ একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য সেলিম খানদের দাবি মোতাবেক জমির মূল্য ৫৫৩ কোটি টাকা আসে। আর জেলা প্রশাসক যে প্রাক্কলন দিয়েছেন তাতে জমির মূল্য আসে ১৯৩ কোটি টাকা। এ বিষয়টি নিয়ে গত বছরের নভেম্বর মাসে জনৈক জুয়েল এবং ডিসেম্বর মাসে সেলিম খান পৃথক দু’টি রিট করেন। এ দু’টি রিটের রায় গতকাল ৯ জুন ঘোষণা করা হয়েছে ।
স্থানীয় প্রশাসন সূত্র জানায়, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত ভূমি অধিগ্রহণের জন্য লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের মেঘনাপাড়ের একটি এলাকা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ৬২ একর ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করতে গিয়ে দেখা যায়, ওই ইউপির চেয়ারম্যান সেলিম খান, তার ছেলেমেয়েসহ অন্যান্য জমির মালিকরা অস্বাভাবিক মূল্যে দলিল তৈরি করেন। ফলে ওই জমি অধিগ্রহণে সরকারের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৩ কোটি টাকা। জমির অস্বাভাবিক মূল্য দেখে সাবেক জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বিষয়টি তদন্ত করলে বেরিয়ে আসে সরকারের কয়েকশ কোটি টাকা লোপাটের পরিকল্পনার তথ্য।
ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে জেলা প্রশাসক উল্লেখ করেন, ওই মৌজায় জমির মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার কানুনগো ও সার্ভেয়ারদের সমন্বয়ে ১৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা প্রশাসক। ওই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই করে দেখা যায়, অধিগ্রহণ প্রস্তাবিত ও পূর্বে অধিগ্রহণকৃত দাগগুলোর জমির হস্তান্তর মূল্য অস্বাভাবিক।
এছাড়া এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ায় জনস্বার্থ ও সরকারি অর্থ সাশ্রয়ে অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যে সৃজন করা দলিল ছাড়া ১১৫ নম্বর লক্ষ্মীপুর মৌজার অন্যান্য সাফকবলা দলিল বিবেচনায় নিয়ে ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা অধিগ্রহণের প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়। উচ্চমূল্যের সেই দলিলগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রাক্কলন তৈরি করলে সরকারের ৩৫৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা ক্ষতি হতো। এছাড়া মৌজা মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সাধারণ জনগণ ভূমি হস্তান্তরসহ নানা বিষয়ে সমস্যায় পড়তো।
এদিকে, সরকারি অর্থ সাশ্রয়ের পক্ষে অবস্থান নেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাছির উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু নঈম পাটওয়ারী দুলালসহ একটি অংশ। সরকারি অর্থ লোপাট চেষ্টার পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ার পর শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা।
এ বিষয়ে চাঁদপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ জানিয়েছিলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকার প্রাক্কলন দিয়েছি। মন্ত্রণালয়কে বলেছি, সব দলিল ধরে মূল্য নির্ধারণ করলে দাম হতো ৫৫৩ কোটি টাকা। আর যে দলিলগুলো উচ্চমূল্যের সেগুলো বাদ দিয়ে প্রাক্কলন করলে দাম আসে ১৯৩ কোটি টাকা। এর বিরুদ্ধে তারা আদালতে রিট করেছিল।
এদিকে রিট মামলা নিস্পত্তি হওয়ার আগেই গত ৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণে জেলা প্রশাসক কর্তৃক প্রাক্কলিত ব্যয় হিসেবে ১৯৩ কোটি টাকা বরাদ্দের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. নাছিম আখতার।
উপাচার্য তার চিঠিতে উল্লেখ করেন, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের বিধান অনুযায়ী সদর উপজেলার ১১৫ নম্বর লক্ষ্মীপুর মৌজার ভূমি সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের স্থান যথোপযুক্ত যাচাইপূর্বক অর্থ বরাদ্দের নিমিত্তে সম্ভাব্য হালনাগাদ প্রাক্কলন প্রদানের অনুরোধ করা হয়। জেলা প্রশাসক ৬২.৫৪৯০ একর জমির সর্বমোট মূল্য ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ ৬৫ হাজার ৫০৭ টাকা প্রাক্কলন প্রদান করেন।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, প্রাক্কলিত অর্থ ১২০ কার্যদিবসের মধ্যে এল এ কেস খাতের নির্দিষ্ট কোড নম্বরে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক কর্তৃক অনুরোধ করা হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ওই অর্থ জমা না দেওয়া হলে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন অনুযায়ী অধিগ্রহণ কেসটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। এ অবস্থায় ভূমি অধিগ্রহণের লক্ষ্যে ওই টাকা জরুরি থোক বরাদ্দ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো।
কিন্তু এ চিঠিতে শিক্ষ মন্ত্রণালয় সাড়া দেয়নি। ইতোমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই জমি অধিগ্রহণের সময়সীমা শেষ হয়ে গেছে।
এদিকে গত ৬ এপ্রিল সেলিম খানের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ যাচাইয়ে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় কুমিল্লার সহকারী পরিচালক রাফী মো. নাজমুস সা’দাতের নেতৃত্বে দুদক এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণের সুযোগে ৩৬০ কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা ও অনেক বছর ধরে পদ্মা-মেঘনা নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করা ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পায় দুদক। সংস্থাটি এখন আরও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে। তথ্য সংগ্রহ শেষে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। ইতোমধ্যেই দুদকের আবেদনে সেলিম খানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। সর্বশেষ ৪ জুন তাকে দলের সকল পদ থেকে আজীবন বহিস্কার করে আওয়ামী লীগ।