মাহবুব আলম প্রিয়
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ ছিলো অনেকটা তলাবিহীন ঝুড়ি। ৭১ এর বিজয় পরবর্তী বিশ্বের বহু দেশের মোড়লরা মনে করতো ভিক্ষুকের দেশ হবে বাংলাদেশ। কিন্তু না! পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। আজ বঙ্গবন্ধুর বাণী অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। দেশের উজ্জলতা ফিরে আসছে। এটা হলো আশার বাণী। বাস্তবে উন্নয়নশীল আমাদের বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। কোভিডে থমকে যাওয়া অর্থনৈতিক বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল। পঞ্চাশ বছরে বদলে যাওয়া নতুন এক বাংলাদেশ দেখছে বিশ্ব। টার্গেট রূপকল্প-২০৪১। এর মধ্যেই উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন । কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীন দ্রব্যমুল্যের লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার দৌড়ে দিশেহারা একটা পরিস্থিতি অস্বীকার করার উপায় আছে কী? দেশের উন্নয়ন তো মানুষের জন্যেই। কিন্তু সে মানুষগুলোই তো আজ হাহাকার করছে। মানুষগুলো উন্নয়ন যেমন দেখছে তেমনি দ্রব্যমূল্যের অব্যাহত বৃদ্ধির কারনে ক্রমেই বাড়ছে দারিদ্র্যের হার। তারা তাদের আয়ের সঙ্গে বাজারের পন্যমুল্যের খাপ খাওয়াতে পারছে না। এতে দিশেহারা জীবন যাপন করছেন দেশের নিন্ম আয়ের লোকজন।
দেশের ভৌত-অবকাঠামো, রাস্তাঘাট-ব্রিজ-যানবাহন, বিদ্যুৎ, টেলিফোন সব কিছুই এখন আধুনিক । বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও কিছুটা ভালো। স্বাধীনতা পরবর্তী সহায়-সম্বলহীন, নিঃস্ব কোটি শরণার্থীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। ঘরে ঘরে ক্ষুধার্ত মানুষ, বাইরে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্নীতিসহ আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতিসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো দাঁড় করা, সংবিধান তৈরি, পররাষ্ট্রনীতি তৈরি, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়, আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্যপদ লাভ, সাড়ে সাত কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান- সবই সামলিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও তাঁর দেখানো পথে হেঁটে বর্তমানে উন্নয়নের রোল মডেল আজকের বাংলাদেশ। এতো নানা আশায় দিন এগুচ্ছে। কিন্তু ম্লান করে দিচ্ছে পন্যের বাজার। সিন্ডিকেট রোধ করা বা বৈশ্বিক দাম বাড়ানোর অযুহাতে নাভিশ্বাস পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
তবে উন্নয়ন যাত্রা বেশ সফল। রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ দাবী ছিলো এ দেশের আপামর জনতার। শুধু অর্থনৈতিক মুক্তি স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল আকাঙ্খা ছিল। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ছিলো গভীর ভাবনা। শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে উন্নয়ন সীমাবদ্ধ নয়। সুদৃঢ় গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাও আগামী দিনের রাজনীতির জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বিগত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭৫ গুণ আর জিডিপি বেড়েছে ৩০ গুণ। স্বাধীনতার আগে দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল ৮৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী, বর্তমানে এই সংখ্যা ২০ শতাংশের কম। বিগত প্রায় ৫০ বছরে ধান-চালের উৎপাদন প্রায় চারগুণ হয়েছে। ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ থেকে ৪ শতাংশ। বর্তমানে রয়েছে ৮ শতাংশের ওপর।
করোনার ধাক্কা কাটিয়ে মেগা প্রকল্পগুলোর কাজে এসেছে পূর্ণগতি। চলতি বছরে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের লক্ষ্যে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্ব সরকারের। দেশের পদ্মা সেতু চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হওয়া সরকারে সাফল্য। এছাড়া মেট্রোরেল চালু হবে আগামী ডিসেম্বরে। কর্ণফুলী টানেল যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হবে ২০২২ সালের মধ্যেই। রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিটের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দেয়ার আশা সরকারের। আবার শিক্ষায় প্রাথমিকে প্রায় শতভাগ ভর্তি, বছরের প্রথম দিনে বিনামূল্যে নতুন বই আর শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা এখন বিশ্বের কাছে উদাহরণ। তবে চ্যালেঞ্জও আছে বেশ কিছু। এদিকে উচ্চশিক্ষা ছড়িয়ে দিতে একের পর এক বিশেষায়িত পাবলিক বিশ্ব বিদ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে। বেড়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও। তবে মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব, শিক্ষানীতির পুরো বাস্তবায়ন না হওয়া এবং শিক্ষা আইন তৈরিতে দেরি হওয়া দেশের শিক্ষাকে বাঁধাগ্রস্ত করছে।
সূত্রমতে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ভিত রচনা করেছেন বঙ্গবন্ধু। যার অব্যাহত যাত্রায় সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা কাঠামো ও মাধ্যমিক শিক্ষা কাঠামো ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। সব কিছু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিশুদের কল্যাণে করা হয়েছে। শিক্ষাকে আনন্দের উপকরণে রূপান্তরিত করা এবং শিশুদের পরীক্ষাভীতি থেকে মুক্ত করা হচ্ছে।
গ্রামাঞ্চলে এখন ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ। বার্ষিক মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। বর্তমানে মুল সংকট এ বিদ্যুৎ। বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বাড়ানোর কারনে এমন সংকটের কথা বলা হচ্ছে। তবে এতেও যে সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র নেই তা বলা যাবে না৷
এছাড়াও মহাকাশে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১,। প্রস্তুতি চলছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের। উন্নয়নের রোড ম্যাপ ধরে নির্মিত হচ্ছে পায়রা সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল। অন্যদিকে গত ৫ দশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিগ্রস্ত দেশের প্রতিনিধি হিসেবে নেতৃত্ব দেয়া, তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উঠে আসা, শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যাপক অংশগ্রহণ ইতিবাচক ইমেজ তৈরি করেছে। জঙ্গীবাদ দমনে সাফল্যের দিকটিও প্রশংসা পেয়েছে। মাথাপিছু গড় আয় ও আয়ু, নবজাতক ও মাতৃমৃত্যু হ্রাস, টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। বিস্ময়কর অগ্রগতি ঘটেছে কৃষি খাতে। করোনার দুঃসময়ে আমাদের রপ্তানি আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, বরং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হার বেড়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভও বেড়েছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৫৪ ডলার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ৫০ বছরে অর্জন অনেক, তবে ব্যর্থতাও কম নয়। গত ৫০ বছরে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার শুরু এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়া সবচেয়ে বড় অর্জন। তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনাই আমাদের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে কেনা সংবিধানের মূল চেতনা ফেরত আনা জরুরি। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে এটিই আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত।
এবার আসি এতো উন্নয়নের পরও জনগণ কেন ভালো নেই। জনগণ বলতে এদেশের নিন্ম আয়ের মানুষজন চরম বিপাকে রয়েছে। কারন তারা অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন।
কারন, প্রায় আঠারো কোটি জনগণের এই দেশ, বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত লোকের বসবাস। মধ্যবিত্তদের মধ্যে বেশির ভাগই হলো গার্মেন্টস কর্মী অথবা শিল্প কারখানায় কাজ করে কিংবা বিভিন্নভাবে দিনমজুরের কাজ করে খেটে খাওয়া লোক। তাদের মাসিক আয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা অথবা ২০-এর ঘর ছুঁই ছুঁই করতে গিয়েও ১৬-১৭ হাজারে এসে থেমে গেছে আয়। এরপর ব্যয়ের হিসাব করলে দেখা যায়। ঘরভাড়া, খাওয়া-দাওয়া, স্কুল ও টিউশন টিচারের বেতন, কোচিং-এর বেতন, ঔষধপত্র, কারেন্ট বিল, গ্যাস বিল সব মিলিয়ে খরচ দাঁড়ায় বেশ মোটাসোটা। দেশের সবকিছুতেই ভ্যাটের পরিমাণ বেড়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দ্রব্যমূল্যের দাম। তেলের দামের সঙ্গে বেড়েছে তেলজাতীয় খাবারের দাম। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু এদিকে বেকার জনগণ ক্ষিদে পেটে নিয়ে জীবিকার সন্ধানে ঘুরছে। এই অর্থনৈতিক চরম মন্দার দিনে কেউ কাউকে এক পয়সার সাহায্য করতেও রাজি না। এ ছাড়া বাংলাদেশে বর্তমানে চলছে মুদ্রাস্ফীতি। এই অবস্থার সবচেয়ে বেশি স্বীকার হচ্ছে মধ্যবিত্তরা। এরা না পারে কারও কাছ থেকে হাত পেতে কিছু নিতে আর না পারে মুখ ফুটে কিছু বলতে। দেশের এত এত উন্নয়নের মধ্যে তাহলে কী জনগণের মঙ্গলটাই বৃথা? বাজারে আটা, রুটিসহ চাল-ডাল এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্যের দাম নিন্ম আয়ের লোকজনের নাগালের বাইরে। ফলে দেশের জনগণকে ভুগতে হচ্ছে পেটের পীড়ায়। আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, সে সুযোগ কজন লোকের আছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য পর্যন্ত চরম অবস্থায়। চারদিকে চলছে শুধু মধ্যবিত্তের হাহাকার, এর মধ্যে কেউ কেউ আবার বাসাভাড়া দিতে না পেরে পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছে দেশের এই অর্থনৈতিক চরম মন্দার দিনে। দেশের উন্নয়নের আগে, দেশের জনগণের কথা চিন্তা করা উচিত নই কী! জনগণ না বাঁচলে উন্নয়ন করে কী হবে! মাসিক ইনকামে ঠিকমতো ভরণপোষণ হচ্ছে না সংসারের, পকেটের টাকাগুলো খরচ করতে গিয়ে বুকের পাঁজরের হাড় খুলে যাচ্ছে মতো অবস্থা মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর। দেশের এমন দিন চলতে থাকলে দেশের প্রতি জনগণের অনীহা চলে আসতে বেশি দেরি হবে না। দেশের নানান সম্পদ, নানান চোরা চালানের মাধ্যমে বাইরের দেশ লুটে নিচ্ছে। দেশের অর্থ চুরি করে নিচ্ছে বাইরের দেশ। এতে দেশের উন্নয়ন খাত থেকে শুরু করে ভিন্ন ভিন্ন খাতে চরম বিপর্যয় নেমে আসছে। দেশে টোলের হার বাড়ছে এবং হচ্ছে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার দায়। এ দেশ এবং জনগণ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে বিপর্যয়ের দিকে। দেশের এবং দেশের জনগণের উন্নয়নের জন্য সরকারের উচিত উপযুক্ত ব্যবস্থাসহ দ্রব্যমূল্যের চড়া দাম থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করা। নয়তো জনগণ তার পেটে বাঁধা পাথর খুললে নিজেদের প্রাণহানী ঘটার আশঙ্কাই বেশি৷ মোদ্দা কথা হলো, দেশের জনগণ একদিকে যেমন উন্নয়ন চায় অন্যদিকে তারা চায় ৩ বেলা ভাত,মাছ, ডাল খেয়ে জীবন অতিবাহিত করতে। তারা চায় শুধুমাত্র নিরাপত্তা। তাদের চাহিদা কেবল শান্তিতে থাকা৷
লেখক- সাংবাদিক