শিরোনাম:
মতলবে পাওনা টাকাকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখম, মালামাল লুট মতলব দক্ষিণে পরিত্যক্ত রান্নাঘর থেকে মরদেহ উদ্ধার মতলব উত্তরে খেলাফত মজলিসের বিক্ষোভ মিছিল মতলব দক্ষিণে ভেটেরিনারি ফার্মেসীগুলোতে অভিযান, চাঁদপুরে সম্পত্তিগত বিরোধ : হাতুড়ির আঘাতে বড় ভাইয়ের মৃত্যু মতলবে সরকারি গাছ নিধন: বনবিভাগ-এলজিইডির দোষারোপে জনরোষ মতলব উত্তরে নিশ্চিন্তপুর ডিগ্রি কলেজে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নবীনবরণ অনুষ্ঠিত মতলব সরকারি কলেজে নবীন শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠিত আমিরা বাজার থেকে লতিফগঞ্জ সড়কের বেহাল দশা চাঁদপুর ২ আসনের বিএনপি নেতা তানভীর হুদার রাজনৈতিক প্রচারণায় ডিজিটাল যাত্রা, চালু করলেন অফিসিয়াল ওয়েবসাইট

বাজারে দাবানল ; নিন্মবিত্তের নিরব কান্না

reporter / ৩৪২ ভিউ
আপডেট : শুক্রবার, ২৬ আগস্ট, ২০২২

মাহবুব আলম প্রিয়ঃ
একই ছাঁদের নিচে শ্রেণি বৈষম্যের শিকার কর্তা আর কর্মী। এটি জাতগত বৈষম্য নয়। জীবিকা নির্বাহের পদ পদবী ধারন আর আয়ের বিস্তর তফাৎ আমরা দেখি সবখানে। সরকারী কিংবা বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে রয়েছে বেতন বৈষম্য।  যেখানে কর্তার বেতন হয় মাসিক নুন্যতম ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১ লাখের অধিক আর একই কর্মঘণ্টা শ্রম বিনিয়োগ করে কর্মী পায় মাত্র ১০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা মাত্র।  অথচ এই কর্তা আর কর্মীর জন্য হাট  বাজার একই।  যদিও কর্তাদের অনেকে বিদেশের হাট বাজারে, বিনোদনে বিলাসীতা করে থাকেন। তাদের সন্তানদের লেখাপড়া ও তাদের রোগ হলে চিকিৎসা হয় সিঙ্গাপুর, লন্ডন, নিউইয়র্কের মতো উচ্চ বিলাসী রাষ্ট্রে। তবে
পণ্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা থাকে কেবল নিম্নবিত্ত আর হত দরিদ্র পরিবারের সদস্যরা। প্রতিনিয়ত আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে গলদঘর্ম হচ্ছেন তারা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এখন আগুন নয়, তুলনা করা হচ্ছে দাবানলের সঙ্গে। চাল-ডাল-তেল থেকে শুরু করে অতিপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দামের একই অবস্থা। সংকট হলো ওই মধ্যবিত্ত,নিন্মবিত্তের লোকেরাই কর্মী হিসেবে বেতন পায় নিন্মসংখ্যার অর্থ।
নিত্যপণ্যের দামের এমন ঊর্ধ্বমুখীর জন্য বিগত সময়ের  করোনা মহামারিতে উৎপাদন কমে যাওয়া, বিশ্ববাজারে অস্থিরতা, অতিরিক্ত আমদানি নির্ভরতা, সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ও সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীদের কারসাজিকে দায়ী করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। বাস্তবে সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীরা তাদের অপকৌশল প্রয়োগ করে ক্ষমতার গন্ডি ব্যবহার করে। তারা নিজেরা গড়ে তুলে শক্ত সিন্ডিকেট ।  তারা জিম্মি করে উদ্যোক্তা,শিল্প মালিক, কৃষক কিংবা বাজারের ডিলারদের। এমনকি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করাতেও দ্বিধা করেন না।
 তবে অভ্যন্তরীণ বাজারের সুশাসনের অভাব রয়েছে এমন কথার প্রমাণ রয়েছে। সেখানে সঠিক আইনের প্রয়োগ ও তদারকির সংকট দায়ী বলে মনে করেন সুশীল সমাজ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ শুরু থেকেই নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন। এতে অব্যাহতভাবে বাড়ছে মূল্যস্ফীতির হার। যার প্রভাব দেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনে। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক অস্থিরতাও তৈরী হয়েছে।  সভা সমাবেশে প্রতিবাদ হচ্ছে জোড়ালে। যদিও এসব প্রতিবাদ প্রতিহত করতে সরকার বিব্রত ।
নিত্য পন্যের মাঝে  সয়াবিন তেল, ডাল, চিনির দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। এর প্রভাব ওই কর্তা শ্রেণিদের উপর পড়েনি। পড়েছে একই ছাঁদের তলায় থাকা নিন্ম আয়ের কর্মীর পরিবারে। কারন  যে কর্তার ৪জনের সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের মাসিক বেতন ১ লাখ টাকা তার মাসিক ব্যয় যা৷ নিত্য প্রয়োজনীয় পন্যের মুল্য অনুযায়ী একই সংখ্যক পরিবারের সদস্যসহ  ৩০ হাজার টাকা আয়করা কর্মীর ব্যয় অনেকটা তা। ফলে বাজারে সাম্প্রতিক মুল্য বৃদ্ধির কারনে পুরোপুরি প্রভাব পড়েছে শুধুমাত্র নিন্মআয়ের লোকজনের উপর।
এদিকে সরকার বাজারে অস্বাভাবিক  মুল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে  টিসিবির কার্যক্রম চালু রেখেছেন।  তবে তা পর্যাপ্ত নয়। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তুলনায় এ আয়োজন অতি সামান্য।  তাই টিসিবির গাড়ীতে লম্বা  লাইনে নিম্নআয়ের মানুষের পাশাপাশি মত্তবিত্তরাও আজকাল দাঁড়ায়। কারন, মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে বাড়ছে না আয়। ফলে টিসিবির লাইন দীর্ঘ হচ্ছে।
রাজধানীর অদূরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের শিল্পনগরী অঞ্চলে শ্রমিক শ্রেণির নিরব কান্না শুনা যাবে কান পাঁতলেই। এমন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, চাল-ডাল থেকে তেল-নুনসহ এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি। তারা  যা আয় করেন তা দিয়ে এখন আর কোনোভাবেই সংসার চলছে না! তাই কাজ শেষে বাসায় যাওয়ার সময় রাস্তায় কম দামে যে সবজি পান  তা ক্রয় করতে বাধ্য হন। এমন নিম্নআয়ের মানুষগুলো ভোর  হলে আড়ৎ থেকে ফেলে দেয়া বা নষ্ট হওয়া মাছ ক্রয় করে আমিষের জোগান নেন। তারা নিজের জন্য পোষাক ক্রয় তো দূরের কথা সন্তানদের ভালো পোষাক ক্রয়েই হিমসিম খাচ্ছে। কারন মাসে যা আয় হয়।তা চলে বাজার নিত্য পন্য ক্রয়ের পেছনে৷ আয় তো দূরের কথা তাদের ঋণ করে কোনমতে চলে সংসার৷  মোটকথা তারা এখন দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতে পিষ্ট। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন এসব শ্রমজীবীরা। আয় কম খরচ বেশি হওয়ায় আয়-ব্যয়ের হিসাব কষতে এখন দিন পার করছেন তারা।
বাজারের আগুনে শুধু নিম্নআয়ের মানুষ নয়, মধ্যবিত্তরাও দিশেহারা বলে জানা গেছে। একই অবস্থা প্রবাসীদের পরিবারেরও। নিন্ম আয়ের মানুষের এখন বাজারে এলেই তাদের পকেট ফাঁকা হয়৷  তাদের সংসারের হালে চাহিদা থাকে বাচ্চাদের দুধ। আগে প্রতি প্যাকেট ৩৪০ টাকায় কিনলেও এখন ৩৭০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ২২ টাকার সাবান এখন ৪০ টাকা। তেলের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। চাল-ডালসহ সব নিত্যপণ্যেরই দাম বেশি। মাস শেষে ঘরভাড়াসহ সংসারের অন্যান্য খরচ মেটাতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাদের। আবার জ্বালানি মুল্যের প্রভাবে সব পন্যের লাগামহীন দামের কাছে জিম্মি হয়ে আছে জনসাধারণ।
  এদিকে শ্রমিক ও কর্মীশ্রেণিরা যেমন তাদের  জিনিসপত্রের নিয়ে হতাশ তেমনি বেতন বাড়ার দাবী তুলছেন।
কেন এমন দরিদ্রদের উপর প্রভাব?  এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণ কিভাবে? এমন প্রশ্নে বিশেষজ্ঞরা দাবী করছেন,  নিয়মিত বাজার মনিটরিং করার অভাব থেকে লাফিয়ে দাম বাড়ে। ব্যবসায়ী ও  দোকানদার ইচ্ছেমতো দাম নিচ্ছে, একেক দোকানে,একেক প্রতিষ্ঠানে একেক দাম।   পাইকাররা দাম বাড়ালে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়াতে হয়। ভোক্তার অধিকার নিয়ে কাজ করে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির মতে, সরকারের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাবে, যদি সরকার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী লাগাম টেনে ধরতে না পারে কিংবা আয়বৈষম্য কমানো না যায়।
ক্যাবের সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, সবকিছুর দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনীতি মুদ্রাস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপীই এক ধরনের মুদ্রাস্ফীতির প্রবণতা রয়েছে। আমাদের আমদানি ও রপ্তানি বেড়েছে, বেড়েছে তারল্য প্রবাহ। যার প্রভাব বাজারেও এসেছে।
 অন্যদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে জাহাজ ভাড়া বেড়ে গেছে। যার ফলে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বর্তমানে চাল থেকে শুরু করে সকল পণ্য এখন আমদানিনির্ভর। কোনো কোনো পণ্য ৮০-৯০ শতাংশ, কোনো পণ্য ৫-১০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। কম পরিমাণ আমদানি হলেও সরবরাহ চেইনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
তিনি বলেন, আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের সুযোগসন্ধানী আচরণ। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম বাড়ে তখন সাথে সাথে দেশের অভ্যন্তরে পণ্যের দামও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। যখন দাম কমে, তখন পণ্যের দাম কমার প্রবণতা দেখা যায় না। এ বিষয়টি ব্যবসায়ীদের খাতায়ই নেই।
সরকারের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত ভোক্তাদের বিপক্ষে যাচ্ছে এমন মন্তব্য করে তৃতীয় কারণের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, যেমন- ডিজেলসহ জ্বালানি তেলের দাম ওই সময় বৃদ্ধি না করলেও চলত। কারণ, বিগত কয়েক বছর জ্বালানি বিভাগ প্রচুর লাভ করেছে।
আমরা সবসময় বলে এসেছি ভর্তুকির দরকার নেই, যখন বেশি দামে জ্বালানি তেল বিক্রি হয়েছে, তা দিয়ে একটি ‘প্রাইস স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড’ তৈরি করা হোক। যা দিয়ে যখন দাম বাড়বে তখন সেটা সমন্বয় করা যায়। কিন্তু তারা সেটা না করে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয় ও বাকি টাকা  সরকারকে দেয়।
গোলাম রহমান বলেন, নিম্নআয়ের মানুষের জীবনযাত্রার চেয়ে বর্তমান সরকারের প্রধান ফোকাসের জায়গায় হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রবৃদ্ধি। আয়বৈষম্য বেশ বেড়েছে। যার সাথে আইয়ুব সরকারের মিল পাচ্ছি। তখন ২২ পরিবারের প্রসঙ্গটা বেশ সাড়া ফেলেছিল।
বর্তমানে উন্নয়নের মহাসড়কে আছি, কিন্তু উন্নয়নের মহাসড়কে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত যদি পিষ্ট হয়ে যায় তাহলে সেই উন্নয়ন আমাদেরকে পিষ্ট করবে।
সরকারের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাবে, যদি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী লাগাম টেনে ধরা না যায়। অথবা আয়বৈষম্য কমানো না যায়। এক সময় আমরা বলতাম নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন, এখন বলি বাজারে দাবানল চলছে।
তারমতে, ইউক্রেন ও রাশিয়ার বর্তমান সংকটে বাজারে নতুন কোনো প্রভাব পড়বে কি না অবশ্যই বিশ্ববাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থায় সুশাসনের অভাবকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য দায়ী করছেন অনেকে।   নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী, এটি সত্যিই উদ্বেগের বিষয়।  তার ওপর জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি জীবনযাত্রার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণেও পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু নিন্ম  আয়ের মানুষের জন্য সুখবর আসবে কী?
লেখক- সাংবাদিক


এই বিভাগের আরও খবর