দলিল,ওয়ারিশ, রেকর্ডীয় বা ক্রয়সূত্রে ভোগ দখলে বৈধ মালিক হলেও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে নিজ জমি। ভূমিদস্যুদের নানা অপকৌশলের কাছে জিম্মি কিংবা হয়রানী হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেও প্রতিকার পাচ্ছে না ভুক্তভোগীরা। কারন
ভূমি দখলের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নানাভাবে জড়িত থাকে পেছনে জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন, প্রভাবশালী গোষ্ঠী।যাদের সামনে প্রতিবাদের ক্ষেত্র থাকলেও ফলাফল উল্টো জমি মালিকের বিপক্ষে যায়। কারন, অবশেষে জমি ছাড়তে বাধ্য হন জমি মালিকরা।
আমরা সরকারের নিজস্ব সম্পদ বা যেটাকে খাস সম্পদ বলি তাও দখল করে নেয় ভূমিদস্যুরা। কাগজে কলমে খাস, অর্পিত, পয়েস্থি, শত্রু সম্পত্তির মালিকানা সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ওই জমিও ভূমিদস্যুদের কব্জায় চলে যায়। আর যারা দখল করে তারা তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যবহার করে। তার সাথে সরকারের যেসব এজেন্সি আছে বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য যারা থাকে পুলিশ এবং অন্যান্য প্রশাসনের একাংশের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থন নিয়েই তারা এসব কাজ করে৷ শুধু সরকারি সম্পদ নয়, ব্যক্তিগত জমি হাতিয়ে নিতে একই অপ কৌশলে নানা অপরাধ ঘটায় তারা।
এসবের মাঝে আবাসন কোম্পানির হয়ে কাজ করা দালাল শ্রেণিরা যুক্ত থাকে৷
সরকার এমন ভূমিদস্যুতা রোধে আইন করেছেন। এমন অপরাধের আইনে রয়েছে শাস্তির বিধান।
এসব অপ কৌশলের অন্যতম হলো প্রতারনা। জমি মালিককে
ভুল বুঝিয়ে বা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অথবা প্রতারণা করে যদি কোন ব্যক্তি অন্য আরেকজনের কাছ থেকে জমির দান দলিল করলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা থেকে দুই লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে আইনে। তবে আইনের দীর্ঘসূত্রিতায় জমি মালিকরা হতাশ থাকেন। আবার উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, অন্যকে বঞ্চিত করে নিজের হিস্যার চেয়ে বেশি জমি দলিল করার হলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা থেকে দুই লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারেন। এবার আসি ভুমি দস্যুদের অবৈধভাবে দখল প্রসঙ্গে। জমি মালিকের বৈধ কাগজপত্র না থাকার পরেও কেউ যদি ব্যক্তি মালিকানাধীন, সরকারি খাস ভূমি বা কোন সংস্থার জমি জোর করে দখল করে রাখেন, সেজন্য এক বছর থেকে তিন বছরের কারাদণ্ড, এক লক্ষ থেকে তিন লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। একইভাবে প্রতিবেশীর বা সহ উত্তরাধিকারীর প্রাপ্য জমি জোর করে দখল করে রাখলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা থেকে দুই লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। দখলের সঙ্গে জড়িত লাঠিয়ালও দণ্ডিত হতে পারে।
অবৈধ দখল গ্রহণ ও বজায় রাখতে পেশিশক্তি ব্যবহার,
অস্ত্র প্রদর্শন, প্রাণনাশের হুমকি ইত্যাদি দেয়া হলে সেটি জামিন অযোগ্য অপরাধ হবে। এমন হলে ছয় মাস থেকে তিন বছরের কারাদণ্ড, এক লক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
বেশি জমি লিখে নিলে জমির পরিমাণ এক একরের বেশি হয় এবং ল্যান্ড ডেভেলপার বা রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার জড়িত থাকে, তাহলে দুই থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, পাঁচ লক্ষ থেকে ২০ লক্ষ টাকা জড়িমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। প্রতিবেশী ভূমি মালিকের ক্ষতিসাধন করলে
বা কোন পরিবর্তন করলে এক বছর থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, তিন লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
অপরাধ সংঘটনে সহায়তা বা প্ররোচনাকারীও শাস্তির বাইরে নয়।
সরকার ভুমি দস্যুতায় আইন করে রেখেছেন। কোথায় কোথাও শাস্তি হচ্ছে। তবে তা সময় স্বাপেক্ষ ও জমি মালিককে সচেতন ও সাবলম্বি, ক্ষমতাসীন হতে হবে।
আবাসন কোম্পানির অধীনের লোকজন ভূমিদস্যুতায় সবচেয়ে বেশি জড়িত। রাজধানী পাশে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার চিত্র দেখলেই বুঝা যায় ভুমি দস্যুরা কত বড় ক্ষমতাসীন। সূত্রমতে, এ অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের প্রকাশ্য অংশ গ্রহণে দিনে দুপুরে ফসলি জমি ও বসত ঘরে বালি ফেলে দখল করা হয়েছে হাজারের অধিক একর জমির। প্রথমে জমি মালিককে ভাড়ায় সাইনবোর্ড, তারপর বালি ফেলে ফসলের ক্ষতিপূরণ লোভ দেখিয়ে জমি মালিকদের জমি দখলে নেয়।পরে মনগড়া মুল্য হাঁকালে জমি মালিকদের মাঝে নিরীহরা বিক্রি করে দেন। আর যারা বিক্রি করতে রাজি বা সম্মত না হন তাদের জমির মালিকানা নিতে প্রথমে ভুয়া দাতা, ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি ব্যবহার করে, সংশ্লিষ্ট সাবরেজিস্টারকে ম্যানেজ করে জাল দলিল সৃজন করে। এখানে থাকে ভূমিদস্যুদের অপ কৌশল। ভুয়া দাতা হিসেবে ব্যবহার করা হয় বাইরের জেলা থেকে লোক ভাড়া করে। দলিলে নাম ঠিকানা লেখা হয় ভিন্ন তথ্যে। ফলে পরবর্তীতে জমি মালিক এসব কৌশল বুঝতে পারলে দলিল বাতিল করতে আদালতের দ্বারস্থ হয়। এতেও নানা আইনি জটিলতায় সময় লেগে যায় বছরের পর বছর। এতোদিনে আবাসন কোম্পানির হয়ে ভূমিদস্যুতারা প্রকৃত জমি মালিকের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ দিয়ে ফৌজদারি মামলা দিয়ে পুলিশ দিয়ে হয়রানী করে। এভাবে জমি মালিক এক সময় বিরক্ত হয়ে লাখ টাকার জমি হাজার টাকায় বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। এভাবে জমি হাতছাড়া হয়ে গেছে শত শত জমি মালিকদের। তবে বহু মালিকরা মিলে উচ্চ আদালতে আবেদন করে কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও তবে তা দীর্ঘস্থায়ী সমাধা নয়। কারন এমন ভূমিদস্যুতায় জড়িত থাকে একশ্রেনির রক্ষকরা৷
লেখক- সাংবাদিক