ওরা অন্তিম ঘরের কারিগর

reporter / ২১০ ভিউ
আপডেট : বুধবার, ২৪ মে, ২০২৩

—-মাহবুব আলম প্রিয়—-
 শেষ ঠিকানা মাটির বিছানা। বাঁশের ছাউনি আর মাটির দেয়ালের ফাঁকা অংশে নিথর দেহের শেষ পরিণতিকে যেনামে চিনি জানি। তা হলো কবর। এই কবর খুড়তে যাদের অবদান তাদের বেশিরভাগই নিঃস্বার্থবান মহান মানুষ। তারা কবর খুড়েন অধিক পরিশ্রম ব্যয় করে কিন্তু পারিশ্রমিক নেননা এক পয়সাও। তাদের চাওয়া মহান  আল্লাহর সন্তুষ্টি।
অথচ এ মহান লোকগুলো মরহুমের পরিবারের কাছে কিংবা সমাজের চোখে তেমন সম্মানিত থাকে না। কারন গ্রাম এলাকায় যারা কবর খুড়েন তাদের বেশির ভাগই শ্রমিক,নিরীহ, সাধারণ মানুষ। কিন্তু তারা মহান। গরীব বলে ধনীর বিয়ে, খাৎনা,জন্মদিনসহ নানা ঝাঁকজমক অনুষ্ঠানে তাদের দাওয়াত থাকে না। তবে কুলখানি, কাঙ্গালি ভোঁজনে দাওয়াত পেলেও তাদের বসার আসন থাকে পেছনে। কিংবা আইটেম থাকে কম।
অথচ তারা মহান, তারা সেরা অতিথি।  কারন, আমার আপনার মৃত্যুর খবর শুনে যে লোকগুলো নিজের কাজ ছেড়ে দিয়ে শেষ ঠিকানা সাজাতে কাজ করবেন। যত্ন করে আমাকে গোসল দিবেন, জানাজা পড়বেন। তাদের ঋণ কেমনে শোধ করবো??
সারাদেশেই রয়েছেন সাদা মনের এমন মানুষদের বিচরন। শহরের গোরস্তানে পেশাদার ও বেতনভুক্ত গোরখোদক থাকলেও গ্রাম এলাকায় তা থাকে না। তবে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে একদল সাদা মনের মানুষের দেখা পাওয়া যায়।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মধুখালীতে রয়েছে এমন কিছু সাদা মনের নিঃস্বার্থ মানুষ।  যারা ইতোমধ্যে শত গোরখোদকের রেকর্ড  গড়েছেন। শতজনকে তাদের হাতে তৈরী কবরে সমাহিত করেছেন চিরতরে।
এমন একজন দলনেতার নাম ইয়ানুছ মিয়া। তার পিতা মরহুম আব্দুর রাজ্জাক।  স্থানীয়রা তাদের বলেন, অন্তিম শয্যার কারিগর।  আবার কেউ কেউ বলেন শেষ বিদায়ের কারিগর।
দলনেতা ৫০ বছর বয়সী ইয়ানুছের সঙ্গে আরও কাজ করেন ৫৫ বছরের বাবুল, ৪৫ বছরের আনোয়ার,৫০ বছর বয়সী হোসেনসহ তরুণ বয়সের মামুন। তারা পেশায় কেউ কৃষক, দিনমজুর ও ক্ষূদ্র ব্যবসায়ী।
 তাদের কবর খোদকের সময় পরম দরদ আর অপার ভালোবাসা দিয়ে সৃষ্টিশীল শিল্পির মতো তৈরি করেন কবর।
 মুসলিম সম্প্রদায়ের শেষ ঠিকানা কবর। জানাজার পর যেখানে ইহজগতে মুসলিম সম্প্রদায়ের লাশের শেষ গন্তব্য হয়ে থাকে। কারও মৃত্যুর খবর শুনলেই  তাদের সব কাজ ফেলে খুন্তি, কোদাল, ছুরি, করাত, দা, ছেন,নীড়কাস্তেসহ কবর খুঁড়তে বা তৈরি করতে সহায়ক সব যন্ত্রপাতি নিয়ে ছুটে যান। নিজ গ্রাম ছাড়াও আশাপাশের গ্রামে, দূর থেকে দূরে কবর খনন করেন তারা।
 ইয়ানুছের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান,  এভাবেই কবর খননের কাজ করে তিনি পার করে দিয়েছেন গত ৪০ বছর।  আর মাত্র ৪০ বছরে শতাধিক কবর খুড়েছেন তিনি। এ পর্যন্ত  কোনো ধরনের পারিশ্রমিক কিংবা বকশিশ না নিয়ে খনন করেছেন কবর।
স্থানীয়দের কাছে
ব্যতিক্রমী পন্থায় মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ সেবাপরায়ণতার এক অনন্য প্রতীক ইয়ানুছ ও তাঁর দল।
 মৃত্যুর পর মানুষের শেষ ঠিকানা মাটিরঘরের নিবেদিত শিল্পী শিমুলিয়ার বাসিন্দা রোমান মিয়া বলেন,
মা বা বাবার কবর করতে দেখেছি গ্রামের লোকদের। দেখলাম খুব যত্ন করে বিনা স্বার্থে কবরের কাজ করছেন।  আমার মনেও ইচ্ছে জাগলো কবর করে দেব কিন্তু পারিশ্রমিক নেব না। শেষ বিদায়ের শেষ ঠিকানা কারিগর হতে পারা সৌভাগ্যের।  তাই গত ২০ বছর ধরে এ কাজ করছি। ইতোমধ্যে ৭০ টির অধিক কবর খোদকের কাজ করতে পেরেছি।
 মধুখালীর তরুন গোরখোদক মামুব মিয়া বলেন, আমি তরুন বয়সে কবর খোড়ার কাজ রপ্ত করছি। কারন আজকাল নতুন করে কেউ কবর খোদকের কাজ করতে চায় না। আমি ইচ্ছে পোষন করেছি। যতদিন বাঁচি কাজের ফাঁকে কবরের কাজ করবো। তিনি আরও বলেন, আমার মা বেঁচে নেই।  কবর করার সময়  আমার কেবলই মনে হয়, আমি যেন আমার মায়ের শেষ ঠিকানাটা সাজিয়ে দিচ্ছি।
গোর খোদক বাবুল  মিয়া বলেন, আমাদের গ্রামের মুরুব্বিদের দেখতে দেখতে  একসময় এ কাজটার প্রতি আমার অন্য রকমের একটি ভালোলাগা জন্মে গেল। কোনো কারণে যদি একটি কবরে শরিক হতে না পারতাম, মনে হতো কী যেন করা হয়নি। টানা ৪৫  বছর ধরে কবরের কাজ করছি।  প্রথমে স্থানীয় গোরখোদকদের সঙ্গে প্রথম প্রথম আত্মীয়-স্বজনের কবর খননের কাজে অংশ নিতাম। ক্রমেই দক্ষতা অর্জন করি।
জনতা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোক্তার হোসেন বলেন, কবর যারা করেন তারাই আসল সাদা মনের মানুষ।  তারা তৈরিতে দক্ষ, নিপুণ কারিগর। আজকাল এমন সেবক পাওয়া দায়। তাই যারা  বড় আদরের এই কাজটিকেই জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। তাদের সমাজে বিশেষ সম্মাননা দেয়া প্রয়োজন। এতে উৎসাহিত হবে নতুনরা।
গোরখোদক রোমান মিয়া বলেন, মানুষের অন্তিম শয়নের কবরটি হতে হবে সুন্দর, নিখুঁত ও সৃষ্টিশীল। কারণ মৃত্যুই জীবনের শেষ ঠিকানা। জন্মের একমাত্র শর্ত হলো মৃত্যু। দুনিয়ায় কত ক্ষমতা, ধন ও সম্পদ। অন্তিম শয়নে কিছুই দেওয়া যায় না। একমাত্র কাফনের কাপড় ছাড়া। তাই বিদায়বেলা কোনো অযত্ন নয়। কবর খুঁড়তে এবং সুন্দর করতে যত জিনিসপত্রের দরকার, সবই ক্রয় করা হয়েছে। সব যন্ত্র নিজ খরচে ক্রয় করেছি।  কথা বলার  সময় আরও জানা যায়,  কবর খনন করার জন্য নিজের খরচায় তিনি কোদাল, দা, করাত, রাম দা, হাতুড়ি, ছোট-বড় খুঁন্তিসহ সব প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরি করে নিয়েছেন।   তিনি আশাবাদি  যখন তিনি মারা যাবেন তার কবর খনন করার জন্য তারই মতো কেউ নিঃস্বার্থ মন নিয়ে খুঁন্তি-কোদাল হাতে এগিয়ে আসবেন।
গোর খোদকদের সাদা মনের মানুষ বলার আরও নানা যুক্তি পাওয়া যায়। তাদের সঙ্গে কথা বললে বুঝা যায় চিন্তা চেতনায় তারা সাধারণ মানুষদের চেয়ে একধাপ এগিয়ে। তাদের মোদ্দা কথা হলো,  সবাই কবর খনন করতে জানে না। তাই অনেকটা সামাজিক দায়বদ্ধতা, মনের প্রশান্তি পাওয়া ও পরকালের পুণ্যের আশায় দীর্ঘ সময় ধরে এ কাজ করে আসছেন। কারও মৃত্যুসংবাদে নিজের সব কাজ ফেলে সবার আগেই বিশেষ যন্ত্রগুলো নিয়ে ছুটে যান তারা। খুব যত্ন করে তৈরি করি মৃত ব্যক্তির শেষ ঠিকানা।
স্থানীয় বাসিন্দা ও সমাজসেবক হাফেজ আব্দুর রহিম  বলেন, সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে যেতে বসেছেন কবর খননকারীরা। এখন যারা আছেন এলাকায়, কেউ মারা গেলে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই নিজেদের কাজ ফেলে তারা ছুটে আসেন। তারা অনেকে দিন এনে দিন খান কিন্তু এ কাজে তারা কোনো পারিশ্রমিক নেন না।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান সমাজব্যবস্থায় প্রয়োজনে তাদের ডাকলেও বাকি সময়গুলোয় এ মানুষগুলোর কোনো খবর আমরা রাখি না। সরকারের উচিত এলাকাভেদে এসব মানুষকে সম্মানীর ব্যবস্থা করা।
রাজনীতিবিদ সাইফুল ইসলাম বলেন,  কবর খননকারীরা সামাজিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন, এটা ভালো কাজ এবং তারা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। তবে এখন পর্যন্ত কবর খননকারীদের সহায়তা করার মতো সরকারিভাবে কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের সামাজিক সম্মাননা জরুরি।


এই বিভাগের আরও খবর