মাহবুব আলম প্রিয় : ব্যঙ্গের ছাতার মতো হাট বাজারে বেড়ে যাচ্ছে বেসরকারি হাসাপাতালের সংখ্যা৷ তবে মান সম্মত চিকিৎসা সেবা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। সুযোগ সন্ধানী একটি পক্ষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ম নীতি না মেনে সিন্ডিকেট করে গড়ে তুলছে নামে বেনামে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অভিযোগ রয়েছে এসব হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে স্বাস্থ্য সেবার নামে নানা ধরনের হয়রানীর। জড়িপ বলছে, শুধুমাত্র
কমিশন বাণিজ্যের কারনে পাড়া মহল্লার ঔষুধ বিক্রেতা, বীমা কর্মী, কতিপয় স্বেচ্ছাসেবক, সংগঠক, সাংবাদিকরাও হয়ে যাচ্ছেন ওইসব হাসপাতালের মার্কেটিং অংশিদার। তারা রোগী সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে পাঠালেই মাস শেষে পাচ্ছেন নির্ধারিত অংকের কমিশন। এতে সাধারণ গরীব রোগী ও স্বজনদের কাছে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়। শুধু তাই নয়, ওই কমিশন ভোগীদের কমিশন দিতে হাসপাতালে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ডাক্তাররাও রোগীর কাছ থেকে নিচ্ছেন অতিরিক্ত টাকা। প্রয়োজন না হলেও পরীক্ষা নিরীক্ষা দিচ্ছেন বেশি। এতে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারও পাচ্ছেন কমিশন। আবার রোগীর পরীক্ষণ যন্ত্রের রেডিয়েশনের প্রভাবে আরও জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
এতোদিন সরকারী হাসপাতালের বিরুদ্ধে রোগী ভাগিয়ে কমিশন বাণিজ্যের চিত্র থাকলেও এবার প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে যোগ হয়েছে এমন অপকর্ম। এতে রোগী প্রতি বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়।
সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠছে নামে-বেনামে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জেও বেড়েছে যত্রতত্র হাসপাতাল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, এসব হাসপাতালের বেশির ভাগেরই নেই প্রয়োজনীয় সব কাগজ পত্রাদি। যাদের আছে তাদের ডাক্তার ভিজিট পরীক্ষার খরচ, অপারেশন ফি অনেকটা ঢাকার নামী দামী হাসপাতালের মতোই। এসব নানা কারনের সঙ্গে কমিশন বাণিজ্যে ক্রমাগত বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়। আবার এক শ্রেণির নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত অর্থলোভী চিকিৎসক বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরির সঙ্গে গোপন চুক্তিতে রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর কমিশন গ্রহণ করছে। অভিযোগ রয়েছে, কমিশনের লোভে বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষারও করাচ্ছেন। এমনকি নিজের পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়ে আনতে বাধ্য করছেন তারা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মেডিকেল কলেজসহ সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে এমআরআই, সিটি স্ক্যান, এক্সরেসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে পড়ে থাকার নেপথ্যেও রয়েছে কমিশন বাণিজ্যে। স্বাস্থ্য সেক্টরে কমিশন বাণিজ্যের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও এটি বন্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা স্বাস্থ্য অধিদফতরের কার্যকর কোনো পদক্ষেপই নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ডাক্তারদের কমিশন বাণিজ্যের কারণে রোগীর চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। কমিশন না পেলে চিকিৎসকরা রোগীকে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেয়ার ভয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে নিরুপায় হয়ে কমিশন দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এ কমিশন বাণিজ্য বন্ধ করা গেলে চিকিৎসা ব্যয় অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন তারা।
সূত্রমতে, দেশের এক শ্রেণির ডাক্তারের কমিশন বাণিজ্যের কারণে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। দেশের প্রচলিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ডাক্তাররা কোন ধরনের রোগীকে কী রোগের জন্য কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিচ্ছেন, এ পরীক্ষার আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কী না তা দেখতে অডিট ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না থাকায় এক শ্রেণির চিকিৎসক এমন দুঃসাহস দেখাচ্ছেন। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম কর্মীরা সতর্ক দৃষ্টি রেখে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির মাধ্যমে কমিশন ব্যবসা বন্ধে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতো৷
শুধু তাই নয় কতিপয় ডাক্তাররা “ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া জেনেও তথ্য গোপন রাখেন। নিন্মমানের ঔষুধ ও রোগীকে দেয়া হচ্ছে।
সূত্র বলছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর শতকরা ২০ থেকে ৩০ ভাগ কমিশন প্রদান করেন। এসব কমিশন যিনি ওই হাসপাতালে পাঠান তাকে দেয়া হয়। আর ডাক্তারদেরও থাকে এমন অংকের কমিশন বাণিজ্য। ফলে এসব কমিশন অংক বন্ধ হলে চিকিৎসা ব্যয় বহুলাংশে হ্রাস করা সম্ভব হতো।
নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জের ব্যস্ততম নগরী ভুলতা গোলাকান্দাইল এলাকা। এ এলাকা গত ৪০ দশক ধরে শিল্প বাণিজ্যে ব্যপক পরিচিত। মানুষের বসবাসও অতিরিক্ত। ফলে এখানে গড়ে ওঠেছে দেশের বৃহত্তর পাইকারী কাপড়ের মার্কেট৷ এখানকার সড়কে বেশি চাপ
থাকায় ভুলতা ফ্লাইওভারও হয়েছে এখানেই। এ সুযোগে চিকিৎসা সেবার নামে ভবনে ভবনে গড়ে ওঠেছে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অল্প দূরত্বে ১০ টি হাসপাতাল,ডায়াগনস্টিক সেন্টার থাকায় এসব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মার্কেটিং কাজে নিয়োজিত রেখেছে পাড়া মহল্লার ঔষুধ বিক্রেতাদের। কেউ কেউ স্বেচ্ছাসেবক ও সংগঠকদের রেখেছে কমিশন বাণিজ্যের আঁওতায়৷ এসব মার্কেটিং কাজে নিয়োজিতদের কমিশন দিতে গিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে চিকিৎসা ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছেন । এমনকি স্বেচ্ছায় দান করা রক্ত যোদ্ধাদেরও কমিশন লোভ দেখিয়ে কতিপয় হাসপাতালের মালিক পক্ষ তাদের মার্কেটিং কাজে নিয়োগ করেছে।
এসব বিষয়ে সচেতন মহল মনে করেন, যখন কোন ব্যক্তির রোগ হয় তখন নানা কারনে রোগী ও স্বজনরা অসহায় হয়ে পড়েন। প্রথমে স্থানীয় ঔষধ বিক্রেতার কাছে পরামর্শ চায়৷ এ সময় ঔষধ বিক্রেতা যে হাসপাতাল থেকে কমিশন সুবিধা পায়, ওই হাসপাতালে যেতে পরামর্শ দেয়৷ এ সময় হাসপাতালগুলো সংশ্লিষ্ট রোগী প্রেরকের কোটায় রেফার্ড চিহ্ন রেখে দেয়। এভাবে মাস শেষে কমিশন পাঠিয়ে দেয়া হয় রেফার্ডকারীকে৷
সচেতন মহলের দাবী, রোগীদের বিপদের সময় তাদের কাছ থেকে কৌশলে অর্থ আদায় এটা নিছক প্রতারনা, অমানবিক কাজ। গরীবের রক্তচোষা এমন অপকর্মে লিপ্তরা কখনো নিজেকে মানবিক পরিচয় দিতে পারেন না। তাদের আরও দাবী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কঠোর নজরদারী থাকলে এসব সমস্যা দূর করে চিকিৎসা ব্যয় কমানোসহ নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হতো৷
লেখকঃ সাংবাদিক