শিরোনাম:
মতলবে পাওনা টাকাকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখম, মালামাল লুট মতলব দক্ষিণে পরিত্যক্ত রান্নাঘর থেকে মরদেহ উদ্ধার মতলব উত্তরে খেলাফত মজলিসের বিক্ষোভ মিছিল মতলব দক্ষিণে ভেটেরিনারি ফার্মেসীগুলোতে অভিযান, চাঁদপুরে সম্পত্তিগত বিরোধ : হাতুড়ির আঘাতে বড় ভাইয়ের মৃত্যু মতলবে সরকারি গাছ নিধন: বনবিভাগ-এলজিইডির দোষারোপে জনরোষ মতলব উত্তরে নিশ্চিন্তপুর ডিগ্রি কলেজে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নবীনবরণ অনুষ্ঠিত মতলব সরকারি কলেজে নবীন শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠিত আমিরা বাজার থেকে লতিফগঞ্জ সড়কের বেহাল দশা চাঁদপুর ২ আসনের বিএনপি নেতা তানভীর হুদার রাজনৈতিক প্রচারণায় ডিজিটাল যাত্রা, চালু করলেন অফিসিয়াল ওয়েবসাইট

হাটে হাটে ফড়িয়াদের ফাঁদ; কৃষক ও খামারীরা প্রতারিত

reporter / ২৬৮ ভিউ
আপডেট : মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

মাহবুব আলম প্রিয়
 বাজারের অব্যাহত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আর নিন্ম আয়ের মানুষদের অতি মুল্যের বাজার ভোগান্তি এখন আলোচ্য বিষয়। এ থেকে উত্তোরনে সরকারের নানা বিভাগ পদক্ষেপ নিতে গিয়েও ব্যর্থ। এমনকী  ব্যর্থ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। কারন ফড়িয়াদের দৌড়াত্ম্য রোধ করা সম্ভব হয়নি। ফড়িয়াদের রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। আর কর্তাদের ম্যানেজ হওয়ার প্রবণতাও দায়ী কম নয়। আবার পশুর হাটের ফড়িয়াদের থাকে নিজস্ব ভাষা বা সংকেত। যা সাধারণ জনগণের বুঝার উপায় নেই।
সারা বছরই আলোচনায় থাকে কৃষক তার ন্যায্যমুল্য পায় না। খামারী তার পশু বিক্রি করেও প্রতারিত হয় ফড়িয়াদের মাধ্যমে। এভাবে ধানের দাম কমে যাওয়ায় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এটা খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। ধান-চালের দাম বাড়লেও সমস্যা কমলেও সমস্যা।   যখন উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে যান তখন তারা ন্যায্যমূল্য পান না। আর শুধু ধান-চাল নয়, প্রায় প্রত্যেকটা ফসলের সময়ই কৃষকরা এ বঞ্চনার শিকারে পরিণত হন। আলু, টমেটো, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, বিভিন্ন প্রকার সবজি কোনও কিছুরই ন্যায্যমূল্য কৃষকরা পান না।  একশ্রেণীর ফড়িয়া বা মধ্যস্বত্বভোগী নানা কৌশলে পানির দরে কৃষকের ফসল হস্তগত করে এবং পরে তা অধিক মূল্যে বাজারজাত করে থাকে। বীজ, সার, কীটনাশক, জ্বালানি তেল, যন্ত্রপাতি প্রত্যেকটি উপকরণ বেশি দামে কিনে তারা যে ফসল উৎপাদন করে সে ফসল যখন পানির মূল্যে ফড়িয়া বা মহাজনদের হাতে তুলে দিতে হয় তখন আর কৃষকের চোখেমুখে হাসি থাকে না। অনেক সময় হাটে-বাজারে বিক্রি করতে নেয়া শস্য বা সবজি ফেলে দিয়ে শূন্য হাতে তারা গৃহে ফেরেন। এটাই হচ্ছে আমাদের কৃষি ও কৃষকের নিত্য পরিণতি।
 ফড়িয়ারা পশুর হাটে সাংকেতিক ভাষায় ভাব আদান প্রদান করেন। তাদের ভাষা এলাকাভেদে হয় ভিন্ন প্রায়।  নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের ত্রিপদী এলাকার বাসিন্দা  ৮০ বছর বয়সী ফড়িয়া জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফড়িয়ারা পশুর হাটে ক্রেতা বিক্রেতার সামনেই তাদের নিজস্ব ভাষায় কমিশন রাখার দর চুকিয়ে থাকেন। তাদের এমন  ভাষার মাঝে রয়েছে শিক শ(১শ টাকা)  শিক হাজার(১ হাজার টাকা), জোর শ (২শ টাকা) জোর হাজার(২ হাজার টাকা), খামিস হাজার( ৫ হাজার টাকা)   আশিল হাজার(১০ হাজার টাকা) ,দলাই কুড়ি (৬০ হাজার টাকা) সহ নানা সংকেত। এসব সংকেত সাধারণ ক্রেতা বিক্রেতার বুঝার উপায় নেই। আর এভাবে এক ফড়িয়া অন্য ফড়িয়াদের সঙ্গে প্রকাশ্যে চুক্তি করতে শুনা যায় পশুর হাটে৷ জয়নাল আবেদীন আরো জানান, তিনি বিগত ৫০ বছর ধরে গরু ছাগলের হাটে যাতায়াত করেন। নিজের পালের ছাগল বিক্রি করতে গিয়ে ১৯৭৮ সালে ফড়িয়ার খপ্পরে পড়েন। তার ঐ সময়ের ১ হাজার টাকা মুল্যের  খাসি ফড়িয়ার খপ্পরে  পড়ে মাত্র ৩ টাকায় বিক্রি করে দিতে হয়। সেই থেকে প্রথমে হাটের খেদানী কাজ শুরু করেন। খেদানী হলো কেউ পশু ক্রয় করলে পশুকে মালিকের সঙ্গে হেটে তার বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার কাজ। তখন গাড়ী ও পাকা সড়ক ব্যবস্থা তেমন ছিলো না। তার মতো অনেকেই খেদানী কাজ করতেন। একটা পশু পৌঁছে দিয়ে ৩ থেকে ৫ টাকা আয় করতেন। তারপর তিনি ফড়িয়া কাজ রপ্ত করেন। ফড়িয়ার কাজ করে হাটের দিনে বর্তমানে ২ থেকে ৫ হাজার টাকা রোজগার করতে পারেন। পাশাপাশি দু’একটা গরু ছাগল ক্রয় করে বিক্রি করেও লাভ করেন তিনি। ফড়িয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফড়িয়ারা যে প্রতারক হয় তা ঠিক নয়। মাঝে মাঝে ক্রেতা বিক্রেতার সহায়ক ভুমিকা পালন করেন। কারন ক্রেতাদের অনেকেই পশুর দাম, ওজন জ্ঞান সম্পর্কে ধারনা রাখেন না।  ফলে ঠকে যায় অনেক সময় ৷ এ ক্ষেত্রে ফড়িয়া মধ্যস্থতা করে উভয়ের মনমতো ক্রয় বিক্রয় সম্পন্ন করে দেন। এতে তারা উভয় পক্ষ খুশি থাকে।
তবে কৃষকদের চিত্র ভিন্ন।  তারা  ধানচাষ করলে ন্যায্যমূল্য পানা।   আলু উৎপাদন করলে দাম পায় না। টমেটো ফলালে গরু-মহিষকে তা খাইয়ে দিতে হয়। মরিচ আবাদ করলে তা তুলতে যে খরচ হয় তাও কখনও কখনও পাওয়া যাবে না। মওসুমে ফসলের দাম না থাকলে মওসুম শেষে বেশী মূল্যে বিক্রি করার জন্য ফসল ধরে রাখার ক্ষমতা তাদের নেই, কেননা তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নগদ টাকার দরকার। গোল আলুর ক্ষেত্রে কোল্ড স্টোরেজের যে সুবিধা আছে তাও ত্রুটিপূর্ণ। এখানে মালিকদের বেশি চার্জ দিতে হয়। আবার ঠিকমতো বিদ্যুৎও থাকে না। ফলে আলু, টমেটো, পেঁয়াজ প্রভৃতি পচনশীল ফসল নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া টেম্পারেচার ম্যানেজমেন্ট যথাযথ না থাকায় একই সঙ্গে একই হিমাগারে আলু, টমেটো বা পেঁয়াজের মতো পণ্য রাখলে তা দ্রুত নষ্ট হয়। কারণ এসব বিভিন্ন পণ্য গোডাউনে রাখলে তাপমাত্রাও লাগে বিভিন্ন মাত্রার। আর একসঙ্গে বিভিন্ন পণ্য যদি রাখতেই হয়, তাহলে গোডাউনের টেম্পারেচার নিয়ন্ত্রণের যথাযথ ব্যবস্থা অবশ্যই থাকতে হয়। এসব না থাকায় কৃষকরা বাধ্য হয় মৌসুমে ফসল কমদামের বিক্রি করতে। তার উপর ফড়িয়াদের থাকে ছলচাতুরী।  তারা কাঁচামাল পাইকার,আড়ৎ, খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেদের মনগড়াভাবে ক্রয়ের সময় কম দামে কেনা আর বিক্রির সময় বেশিদামে বিক্রি করেন। এতে সাধারণ ভোক্তা চরমভাবে ক্ষতিগ্রসথ হই।
তবে, কৃষককে মূল্যবঞ্চনার হাত থেকে বাঁচাতে হলে সরকারি ও বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদারভাবে বিনাসুদে মার্কেটিং ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান পক্ষ অথবা সরকারিভাবে কৃষকদের কাছ থেকে ফসল জমা রেখে তার বিনিময়ে ঋণ দিতে পারলে ফড়িয়াদের ফাঁদ থেকে তারা রক্ষা পাবেন। এগুলো সংস্কার করে ধানসহ কৃষিপণ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে কৃষকরা সেখানেও তাদের পণ্য রাখতে পারবেন। এ কাজটি করতে পারলেই কেবল কৃষকরা তাদের পণ্যের মূল্যবঞ্চনা থেকে রক্ষা পেতে পারেন। এ ব্যাপারে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষকদের ঋণ প্রদানের সকল প্রকার জটিলতা নিরসন করতে হবে। ধান-চালের সরকারি সংগ্রহমূল্যের সাথে উৎপাদন ব্যয়ের সামঞ্জস্য থাকা বাঞ্ছনীয়। কৃষক ও কৃষিকে বাঁচাতে হলে ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য প্রতিহত করা খুব জরুরি।
আবার প্রতিবছর কোরবানির চামড়ার বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে ফড়িয়া বা মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। ট্যানারি শিল্প মালিক সমিতির বেঁধে দেওয়া নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে চামড়া কেনাবেচা হওয়ায় প্রকৃত ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েন। অনেক ব্যবসায়ী চামড়া পাচারের আশঙ্কাও করছেন। পাচার ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো এরই মধ্যে সরকারি হস্তক্ষেপ চেয়েও প্রতিকার পায় না৷ ব্যবসায়ীরা।   এর কারণ ব্যাখ্যা করে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব আব্দুল হাই  বলেন, ‘গত বছর দাম নির্ধারণ করে না দেওয়ায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করেছে। কোরবানির চামড়ার বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে ফড়িয়া বা মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। ট্যানারি শিল্প মালিক সমিতির বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে চড়া দামে চামড়া কেনায় বিপাকেও পড়েছে অনেক ফড়িয়া ব্যবসায়ী। কাউকে কাউকে দেখতে হয়েছে লোকসানের মুখ। আবার ফড়িয়ারা বেশি দামে চামড়া কেনায় বাজারে চামড়া কিনতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে পাইকারি ব্যবসায়ীদের। অনেকে তাঁদের চাহিদা অনুযায়ী চামড়া কিনতে পারেননি বলে জানিয়েছেন। ফলে প্রচুর পরিমাণে চামড়া তখনো মাঠেই রয়েছে। এগুলো সীমান্তপথ দিয়ে ভারতে পাচার হয়ে যায়।এখানেও  ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছামতো দাম দিয়ে থাকে।
চামড়া ব্যবসায়ীদের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ কম থাকায় বাইরের জেলা, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলার ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ফড়িয়ার মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে চামড়া কিনে নিয়েছেন। ফলে মূল বাজারে চামড়ার আমদানি কম হওয়ায় দাম বেড়ে গেছে অনেক।
কোথায় নেই ফড়িয়াদের দাপট? বিয়ে করতে যে ঘটক কাজ করেন তার ভুমিকা ফড়িয়াদের মতো। জমি ক্রয়ে দালাল, থানার পুলিশের সোর্স, ভুমি অফিসের ওমেদার, সাবরেজিস্টার অফিসের কেরানী ও পিয়ন, পাসপোর্ট ভিসা ও বিদেশে যাতায়াত এমনকি পবিত্র কাবা ঘরের হজ্জ করতেও ফড়িয়াদের কাছে ধর্না দিতে হয়। যদিও ফড়িয়ারা ভিন্ননামে ভিন্ন স্থানে, কালভেদে, প্রকারান্তরে নানা চরিত্রে দেখা মেলে।  তাদের ফাঁদ কোন কাজে আশীর্বাদ আর বেশির ভাগ স্থানেই ভয়ংকর প্রতারণার ফাঁদ।
লেখকঃ সাংবাদিক


এই বিভাগের আরও খবর